সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি- কোনদিকে যাবেন?

সরকারি নাকি বেসরকারি

গ্রাজুয়েট তো হয়ে গেছেন? এবার ভাবছেন সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি চাকরি করবেন,তাই তো? আর এই ভাবনা টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মধ্যবিত্তরাই ভেবে থাকে।

উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীর কাছে সরকারি হোক বা বেসরকারি হোক – দুটোই থাকে হাতের মুঠোয়। তাই তাদের কে শুধু এটা দেখার দরকার পড়ে -কার কোন টাইপের চাকরিটা ভালো লাগে।

নিম্নবিত্তদের কাছে বর্তমান টাকে সামলানোটাই হয়ে ওঠে জরুরী। তাই তারা দুটোরেই চেষ্টা চালিয়ে যায়। যেটা আগে পেয়ে যায়, সেখানেই পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে জীবন কাটিয়ে দেয়।

মধ্যবিত্তরা থাকে সবচে বড় সমস্যার মধ্যে। কেউ কেউ বড্ড পরিশ্রম করে সরকারি চাকরি জুটিয়ে নেয় ঠিকই, কিন্তু নানান রকম সমস্যার জন্য ভাবতে থাকে –“বেসরকারিতে চাকরি করলেই বুঝি ভালো হত।“

আবার কেউ কেউ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও যখন সরকারি চাকরি জোটাতে পারে না, তখন ভাগ্যকে দোষ দিয়ে দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে বেসরকারি সংস্থাতে খাটতে থাকে গাধার মতো আর,মাইনেও পায় না মনের মতো।  

বৈচিত্র্যে ভরপুর আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। যেমন ভাষার মধ্যে বৈচিত্র্য, ঠিক তেমনই বৈচিত্র্য টাকার পরিমানের মধ্যে- কেউ অন্নের অভাবে, দারিদ্রের জ্বালায় আত্মহত্যা করে আবার কারো বাড়ী সাদা, কালো দুই ধরনের টাকাতে ভারি হয়ে উঠেছে।

এমন দেশে চাকরিতে ভারসাম্য থাকবে না- তা আবার হয় নাকি? আর সেই ভারসাম্যগুলো কি কি তাই নিয়েই আমরা এখানে আলোচনা করবো।

সরকারি চাকরি

২০০৩-২০০৪ সাল অবধি এই সরকারি চাকরি ব্যাপারটাই ছোট চোখে দেখা হত। সেই আমলে সরকারি চাকরি এর বাজার একদম নিচে ছিল। কে জানতো ২০০০ সালে ৫,০০০ টাকার সরকারি চাকরিতে ঢোকা সেই শিক্ষক বর্তমানে এক লাকের ওপর মাইনে পাবেন?

সময় যে কি হারে বদলায় তা এই সরকারি চাকরির বাজারের আমূল পরিবর্তন দেখলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সেই আমলে বেসরকারি চাকরি মানে এক বিশাল স্ট্যাটাস এর ব্যাপার ছিল। আর সরকারি চাকরি ছিল সাদা মাটা মানুষদের জন্য। আর সেই সময়ে সরকারি চাকরি পাওয়া তেমন কিছু টাফও ছিল না।

আজ পাশা উলটে গেছে। সেই সাদা মাটা মানুষদের টাকা বা স্ট্যাটাস এর পাল্লাটা ভারি হয়ে গেছে। কিন্তু তাহলে নতুন করে এই বর্তমানের সাদা মাটা মানুষগুলো তাদের টাকার পাল্লাকে ভারি করতে কেন পারছে না?

সরকার বেসরকারি সংস্থাগুলোতে যারা চাকরি করতো তাদের থেকে ট্যাক্স নিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলল। বেশ কয়েক বছর পর, সরকার যখন ভান্ডার ভরে তুলল, বদলে ফেলল এলিজিবিলিটি ক্রাইটেরিয়া, বাড়িয়ে দিল সিট- চাকরি ভেকেন্সি।

দলে দলে মানুষ apply করতে থাকল সরকারি চাকরিতে। সরকার তখন সামাল দিতে না পেরে শুরু করলো –এন্ট্রেন্স পরীক্ষা। যোগ করলো পরীক্ষায় বসার ফি।

এই পাল্লা যখন এই ভাবে ওপরে উঠছিল ধীর গতিতে, ঠিক তখনই অন্য পাল্লাটি নিজের নামার গতিপথ হয়তো বা বুঝতেও পারে নি।

সরকারি চাকরির সুযোগ সুবিধা

সরকারি চাকরিতে জয়েন করতে চান? মনে মনে কি ভাবছেন যে জয়েন করাটা ঠিক হবে কিনা? কাজের চাপ কেমন থাকবে –এইসব ভেবে উদ্বিগ্ন?

আমরা এখানে আপনাকে সঠিক নির্বাচন করতে সাহায্য করবো।

প্রথমেই বলুন – আপনি কি নিয়ে পড়াশুনো করেছেন? আপনি কি টাইপের কাজ করতে চান?

আপনি যদি টিচিং লাইনে যেতে চান তাহলে সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি চাকরি করবেন?

টিচিং লাইনে সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি চাকরি ভালো?

টিচিং লাইনে জীবন অতিবাহিত করতে চাইলে, নিশ্চিন্তে সরকারি চাকরিতে জয়েন করার প্রয়াস করুন।  এর কারনঃ

  • সবচে Comfort Zone এ থাকবেন আপনি।
  • টিচিং লাইনে সাধারনত ট্রান্সফার হয় না।
  • সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট এ চাকরি করলে, আপনি কোয়ার্টার পাবেন।
  • পেনশেন পাবেন
  • কাজের চাপ- নগন্য। আপনি চাইলে সেই চাপ বাড়াতে পারেন যদি আপনি গবেষণাকার্যে বা নিজের কর্মের উন্নতি চান। আবার আপনি চাইলে ফাঁকিও দিতে পারেন। তবে মনে রাখবেন আপনার ফাঁকি দেওয়া মানে দেশের অবনতি।

আর দেশের অবনতি মানে আপনার প্রজন্মের ক্ষতি, উদ্বেগ। তাই কাজে মন দেওয়াটাই সঠিক নাগরিকের পরিচয় হবে।

  • এই লাইনে সরকারি চাকরিতে যদি মাইনেতে না কুলোয়, আপনি টিউশেন ও করতে পারেন।
  • এই লাইনে সরকারি চাকরি করলে আপনি স্কুল টাইমে আপনার ছেলে মেয়ের কোন কাজে বেরোতে পারবেন।
  • প্রচুর ছুটি পাবেন।

আপনি কি ব্যাংকিং এ যেতে চান? দেখে নেওয়া যাক ব্যাংকিং এর জন্য সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি চাকরি উপযুক্ত?

ব্যাংকিং লাইনে সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি চাকরি ভালো?

ব্যাংকিং লাইনে চাকরি করতে আগ্রহ থাকলে, সরকারি বা বেসরকারি যে কোনটাতেই যেতে পারেন। দুই ক্ষেত্রেই সুবিধে এবং অসুবিধে আছে।

সরকারি ব্যাঙ্কে চাকরির সুবিধে

  • চাকরি সহজে হারায় না।
  • মাইনে বেশী।
  • কোয়ার্টার পাবেন।
  • পেনশেন পাবেন।

ব্যাংকিং লাইনে সরকারি চাকরিতে অসুবিধে

  • ট্রান্সফার হয়।
  • কাজের চাপ বেসরকারি ব্যাঙ্ক এর মতোই থাকে।
  • চাকরি পাওয়া খুবই টাফ।

আপনি কি ইন্ডাস্ট্রি তে কারখানায় কাজ করতে চান? আপনি কি ভীষণ কেরিয়ারিস্টিক? তাহলে দেখে নেওয়া যাক সরকারি চাকরির সুবিধে ও অসুবিধেগুলোঃ

ইন্ডাস্ট্রি তে সরকারি চাকরিতে সুবিধে ও অসুবিধে

  • কোনোরকমে কাজ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বাড়ীতে আয়াস করতে পছন্দ করেন কি? তাহলে সরকারি চাকরিতে যান।
  • কাজ শিখতে চান? বড় হয়ে কিছু করতে চান? কিংবা টেকনোলজি শিখে নিজের ব্যবসা করতে চান? তাহলে বেসরকারিতে চাকরির প্রয়াস করুন। আর চাকরিতে জয়েন করে মন দিয়ে কাজ শিখুন।ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়।

বেসরকারি চাকরি

একটা সময় ছিল যখন বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করা এক বিশাল ব্যাপার ছিল। বিশাল ছিল মাইনে। কলেজে পড়া কালীনই প্রচুর ছাত্র ছাত্রীদের চাকরি হয়ে যেত।

ইঞ্জিনিয়ারদের ছিল বিশাল ডিমান্ড। সেই সময়ে সব পরিবারে যেন একটা হিড়িক লেগে গেছল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য।

প্রাইভেট কোম্পানি তে চাকরি করাটাও বিশাল ব্যাপার ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন যাদের চাকরি হত না তারাই শুধু উচ্চশিক্ষায় যেত।  এখন ছবিটা পুরো উল্টো। ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেও অনেকে বেকারত্বের জ্বালায় ভুগছে, আর আগের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালীন চাকরি হয় না।

বেসরকারি চাকরির সুবিধে

বেসরকারি চাকরির সুবিধে
বেসরকারি চাকরি
  • যদি কিছু শিখতে চান, দুনিয়াটাকে চিনতে চান, তাহলে বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরী করুন। যদি অলসতা আপনার জীবনের মূল মন্ত্র হয় তাহলে বেসরকারি কোম্পানি আপনার জন্য নয়। তবে অলসতা কে ধরে থাকলে, পরে আফসোস হবে। তাই এমনটা না করাই বাঞ্ছনীয়।
  • ছোট, মাঝারি, বড় –সব রকমের কোম্পানি আছে। একটাতে চাকরী না পেলে অন্যটাতে চেষ্টা করতে পারেন।
  • কাজ যদি ভালো করেন, পারফরমেন্স যদি ভালো হয়, অফিসের বসের সাথে ভালো সম্পর্ক যদি করতে পারেন- আপনার প্রোমোশেন আর ইঙ্ক্রিমেন্ট কেউ আটকাতে পারবে না।
  • কাজ ভালো জানা থাকলে, বর্তমানের কোম্পানি ভালো না লাগলে আপনি নতুন কোম্পানিতে চাকরী খুঁজতে পারেন।
  • নতুন কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেলে আপনার ইঙ্ক্রিমেন্ট ১৫-২০% বেড়ে যাবে যদি আপনি সেইভাবে বারগেনিং করতে পারেন।
  • একটা কোম্পানিতে চাকরি চলে গেলে, কাজ যদি ভালো জানেন, তাহলে চিন্তা করার কোন দরকার নেই। আপনি সহজেই অন্য কোম্পানিতে কাজ পেয়ে যাবেন।
  • তবে আপনাকে জব লোকেশেন এর ব্যাপারে ফ্লেক্সিবেল হতে হবে। শুধু কলকাতাতেই চাকরি করবেন, এইরকম মানসিকতা দূর করতে হবে।  
  • বড় কোম্পানিতে বিল্ডিংগুলো খুবই পরিষ্কার, ঝকঝকে আর সাজানো গোছানো হয়।

বেসরকারি চাকরির অসুবিধে

  • সবচে বড় অসুবিধে তখনই হবে যদি আপনি লাজুক হন আর দেখাতে না পারেন যে আপনি কতখানি কাজ করেন। যতটা কাজ করবেন তার বেশী দেখাতে হবে।
  • বসের সাথে সম্পর্ক ভালো না হলে, আপনি ভালো কাজ করলেও আপনার কাজের মুল্য ওই কোম্পানিতে আপনি পাবেন না।
  • হটাত করে কোন একদিন মাথার ওপর ছাদ ভেঙ্গে পড়তে পারে। অবশ্য এই মর্মান্তিক পরিস্থিতি আপনি আগে থেকে টের পাবেন- বসের সাথে আপনার কথোপকথন থেকে।
  • এইরকম পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে না পড়ে ওই কোম্পানিকে দেখিয়ে দিন যে আপনি সহজেই অন্য কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে যাবেন।
  • বেসরকারি কোম্পানিতে যেমন প্রচুর টাকা আছে তেমনই রিস্ক আছে। রিস্ক তো আপনাকে নিতেই হবে। রিস্ক নিতে প্রস্তুত থাকলেই বেসরকারি কোম্পানির কথা ভাবুন।

সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি- সিদ্ধান্ত নিন

 সরকারি বাস দাঁড়ায় না/ আর বেসরকারি বাস নড়ে না।

এইরকম একটা চলতি কথা শোনা যায় যা খুবই সত্য।

ঠিক সেইরকমভাবেই-

সরকারি কোম্পানি সহজে নেয় না আর বেসরকারি কোম্পানি বেশিদিন রাখে না।

রিস্ক বেসরকারি কোম্পানিতে। আরাম, আয়াসি, দুর্নীতি –সরকারি কোম্পানিতে। এই তিনটে জিনিষ যখন সরকার সম্পূর্ণ রূপে মুছে ফেলতে পারবে, আমাদের দেশ হয়ে উঠবে সেরার সেরা।

পরিশ্রমেই পারে সেরা ফসলের বীজ বুনতে। একটা গোষ্ঠীর বদলে দেশের সব মানুষ দুর্নীতিকে ভুলে যদি সমান পরিশ্রম করে, তাহলে সেই দেশ হয়ে উঠবে অর্থনীতিতে মজবুত।

আপনার বাড়ীর আলমারিগুলো যদি এলোমেলো থাকে, তাহলে দেখবেন কিছু জিনিষ কম জায়গা নিয়েছে আবার কিছু জিনিষ বেশী জায়গা নিয়েছে। আর আপনার জায়গা টা তো লিমিটেড। তাই বেশী জিনিষ ওই জায়গায় রাখতে পারবেন না।

ঠিক একিরকমভাবে, আমাদের দেশে কারো হাতে খুব টাকা, আবার কারো হাতে একদমই নেই। কারো বাড়ীতে সবাই চাকরি করে, কারো বাড়ীতে সবাই ডিগ্রীধারী হয়েও বেকারত্বে ভুগছে। সব কিছুই এলোমেলো। আমরা, আপনারা সবাই মিলে দেশটাকে গোছাতে পারি না?

এরপর দেখুন আপনি কোন জিনিষগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে পারবেন, সেই হিসেবে সিদ্ধান্ত নিন। সিদ্ধান্ত যাই নিন না কেন, কাজে ফাঁকি দেবেন না।

ঠিক যেভাবে সরকারি কোম্পানির ডিমান্ড বেড়ে গেল রাতারাতি ঠিক সেইভাবেই তা পড়ে যেতেও তো পারে। তখন তো আপনাকে বেসরকারি কোম্পানির কথা ভাবতেই হবে। আর কাজ ভালো না জানলে বেসরকারি কোম্পানিতে কোন জায়গা পাবেন না।

Love your job, not the company.

Dr. A.P.J. Abdul Kalam

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, সবাইকে ভালো রাখুন। চলুন, সবাই মিলে একসাথে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি। এই পৃথিবীর প্রতিটি কোনা ভরে উঠুক ঈশ্বরের আশীর্বাদে!  

One thought on “সরকারি চাকরি নাকি বেসরকারি- কোনদিকে যাবেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক পোস্ট