বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু কথা

বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু কথা

বার্ধক্যের অক্ষমতা আর অসহয়াতাই কি ৩০ বছর আগের তরুন তরুণীকে আজকের তরুন তরুণী ঠেলে দেয় এই বৃদ্ধাশ্রমে? যে পিতা মাতা পৃথিবীর সাথে পরিচয় করিয়েছে আজকের ওই তরুন তরুণীকে, সেই পিতা মাতার কি এটাই প্রাপ্য ছিল? নিজের তৈরি ঘর ছেড়ে বৃদ্ধাশ্রম?

তাহলে কি এটাই ট্রেডিশেন? আজকের এই তরুন তরুণীও কি  ২০-৩০ বছর পরে জায়গা নেবে ওই একই আশ্রমে?

যে ঠিকানা তৈরি করে, ইটের সাথে বালি, সিমেন্ট, পরিশ্রম আর ভালোবাসা মিশিয়ে অল্প অল্প করে বাসস্থান তৈরি করে, তাকেই কি শেষে নির্বাসিত হতে হয়?

আর এইসবকিছু কে আমরা নীরব দর্শকের মতো দেখে যাবো? আর মনে মনে ভাববো –ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে? তাহলে কি ভাগ্যই এর জন্য দায়ী?

যে তরুন তরুণী ওই বৃদ্ধ বৃদ্ধা কে তাদেরেই তৈরি ঠিকানা থেকে বঞ্চিত করে, সেই তরুন তরুণীর সদ্যোজাত শিশু সন্তানেরা কি শিখবে এই রকম পরিবেশ থেকে? পরিবেশ তো আমরা মানে আজকের তরুন তরুণীরাই তৈরি করে থাকি।

আর পরিবেশ থেকেই তো জন্ম হয় ভাগ্যের। তাই তো ভালো পরিবেশে ভালো মানুষ তৈরি হয় আর খারাপ পরিবেশে খারাপ মানুষ। তবে ব্যতিক্রম কি নেই? নিশ্চয় আছে। আর তাই তো পাঁকের মধ্যে জন্ম নেয় পদ্ম ফুল।

এরপর আপনি হয়তো বলবেন- বৃদ্ধাশ্রম বানানো হয়েছে কেন? দোষ তো প্রশাসনের। আর এইসব কিছুরেই উত্তর দেব এখানে।

বৃদ্ধাশ্রম কি

বৃদ্ধাশ্রম হল বয়স্কদের থাকার জায়গা। অনেকটাই হোস্টেল এর মতো। যে সব বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের দেখার কেউ নেই তাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই আবাসন।

এখানে ঠিক সময়ে সময়ে খাবার দেওয়া হয়।এখানেও হোস্টেলের মতো কমন রুম থাকে। আর এই কমন রুমে টিভি দেখার, বিকেলে পার্ক এ ঘোরানোর ব্যবস্থাও আছে।

ওল্ড এজ হোম
বৃদ্ধাশ্রম

বৃদ্ধাশ্রম এর উপকারিতা

খারাপেরও ভালো থাকে। ঠিক সেইরকমভাবেই হাজারটা খারাপ দিকের সাথে কিছু ভালো দিক আছে। দেখে নেওয়া যাক সেই ভালো দিকগুলো কি কি।

এমন অনেক পরিবার আছে, যা শেষের দিকে। স্বামী স্ত্রী আর তাদের একমাত্র বাচ্চা। এই তিনজনেই তো জমে উঠেছিল সংসার।

আর চতুর্থ জনের দরকারও পড়ে নি। ওই একমাত্র ছেলেই ছিল তাদের দুজনেরই পৃথিবী।

হটাত একদিন, ওই সুখময় জীবন ভেঙ্গে ছারখার হয়ে গেল। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেল। ৩০ বছর বয়সেই এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় তাদের এক মাত্র সন্তানের।

সেই স্বামী স্ত্রী দুজনেই তখন চাকুরি জীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত। একজন ৬০ ,আরেকজন ৬৫।

জীবনের প্রতি এক বিশাল বিতৃষ্ণা। বেঁচে থাকার যে একটা খিদে মানুষের মধ্যে থাকে তা ছেলের মৃত্যুর সাথে আত্মহত্যা করেছে। দুজনেরেই নিত্য সঙ্গী সুগার এবং হাই প্রেসার।

তবুও সব কিছু যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে। নেই মুক্তি এই যন্ত্রণার।

এইভাবেই কেটে গেল আরো কয়েক বছর। এখন ওরা ৬৬ এবং ৭১। এতদিন তো বাড়ীতে কাজের লোক দিয়েই চালিয়েছে। কিন্তু এখন কাজের লোক কে ম্যানেজ করাটাও টাফ হয়ে যাচ্ছে ওদের কাছে।

শুধু রান্না বান্না, ঘর বাসন পরিস্কার ছাড়াও তো আরো অনেক কাজ থাকে। সেইসব কাজ আর করতে ওরা পারছে না।

শুধু অপেক্ষা করছে কখন মুক্তি পাবে এই যন্ত্রণা থেকে। কাজের লোকের ওপর ডিপেন্ড করে থাকাটাও তো কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

সেদিন দুপুর ১টা অবধি অপেক্ষা করলেন ওরা কখন কাজের মেয়ে আসে রান্না করে দেবে। দুজনেই অভুক্ত।

ওই বৃদ্ধা বাথরুমে পড়ে গিয়ে কিছুই রান্না করতে না পারায় অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছিল ওই বৃদ্ধ। সেদিন সেই বৃদ্ধই কোনোরকমে ডাল ভাত রান্না করে খেয়েছিল।

বাঁচতে ওদের আর ইচ্ছে করছে না। কিসের জন্য বেঁচে থাকে। যে গাছে কোন ফুল, ফল নেই সেই গাছ এর কি প্রয়োজনীয়তা? এইসব ভাবনাই হয়েছিল তাদের নিত্য ভাবনা।

এমন বিষাদগ্রস্ত জীবনে রাস্তার ধারে আটকানো বিজ্ঞাপন দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়েছিল বৃদ্ধ।

বেঁচে যখন থাকতেই হবে, টাকাও যখন হাতে আছে, তখন সেই বিজ্ঞাপন থেকে নাম্বার নিয়ে কল করলেন বৃদ্ধ।

আজ তাদের মুখ থেকেই শুনে নেব এই বৃদ্ধাশ্রম এর উপকারিতাগুলো কি কি।

১। ঠিকানা

ঠিকানা যে তাদের ছিল না তা নয়। কিন্তু সেই দীর্ঘদিনের ঠিকানা কে টিকিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল ওদের পক্ষে।

বার্ধক্য আর পুত্র হারানোর শোকে যখন জর্জরিত, জীবন যখন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছিলো, তখন এই বৃদ্ধাশ্রম নতুন করে বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে।

ওই তিন কামরার ফ্ল্যাট টা ভাগ্যিস তারা বিক্রি করে দিয়েছে। কি হবে ফ্ল্যাট এর ওপর মায়া বাড়িয়ে? কে আছে যে ফ্ল্যাট টার সাথে ওদেরও দেখাশুনো করতো ওই খানে?

এখানে তো বিশাল বড় ক্যাম্পাস। একদিকে বৃদ্ধদের থাকার জায়গা, আরেকদিকে বৃদ্ধাদের থাকার জায়গা। মধ্যখানে সুন্দর পার্ক। কিছু দুরেই বাচ্চাদের অনাথ আশ্রম।

২। সঙ্গী পাওয়া যায়

ঘুমনোটা হয়তো একসাথে তাদের আর হয় না। কিন্তু তাতে কি? প্রত্যেকদিন বিকেলে পার্কে একসাথে বসে যখন তারা থাকে, তখন যেন এন অনাবিল আনন্দ তাদের চারিদিকে।

ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা গুলো যখন দাদীমা, দাদু বলে ডাকে মন তাদের আনন্দে ভরে যায়। জন্মদিন গুলো খুব সুন্দরভাবে সেলিব্রেট করা হয়।

স্বামী স্ত্রী দুজনেই যারা বেঁচে আছে তাদের জন্মদিন পার্কে সেলিব্রেট করা হয়। এমন কি মেরেজ এনিভারসারিও সেলিব্রেট করা হয়।

জীবন তো তাদের সব ভুলিয়ে দিয়েছিল, সুন্দর স্মৃতিগুলো পুত্রশোকের সাথে হারিয়ে গিয়েছিল। এই বৃদ্ধাশ্রম ই তো তাদের সব স্মৃতি আবার নতুন করে মনে করিয়ে দিল।

সঙ্গীর কোন অভাব নেই। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাগুলোও সঙ্গী। পার্কের মধ্যে যে দোলনাটা সেটাও সঙ্গী।

পাশের রুমের বৃদ্ধারা তো সবচে বড় সঙ্গী।

৩। নিয়মিত ঠিক সময়ে খাওয়া হয়

খাওয়ার ব্যাপারে কোন চিন্তা করতে হয় না। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের সময়ে ঘন্টা বাজার সাথে সাথে আরো অনেক সঙ্গীদের সাথে কমন রুমে যাওয়ার আনন্দই আলাদা।

একসাথে গল্প করতে করতে খাওয়ার মজায় আলাদা।

৪। হাঁটা চলা, ব্যায়াম

এই বার্ধক্যের মধ্যেও সব্বাই প্রত্যহ সকালে পার্কে হাঁটতে, ব্যায়াম করতে যায়। কেউ কেউ শুরুর দিকে কিছুতেই যেতে চায় না।

জীবন তাদের এতো যন্ত্রণা দিয়েছে যে তারা আর জীবনে হাঁটতে পারে না।

হাঁটতে হাঁটতেও ওই বৃদ্ধা শুনেছে আরো কতো বৃদ্ধা ওদের চেয়ে কতো বাজে কন্ডিশেনে আছে। তারা স্বেচ্ছায় আসে নি এই ঠিকানাতে। তারা ব্যায়াম করতে করতে শুধু কাঁদতে থাকে।

বেশ কয়েকদিন পরে ধীরে ধীরে তারা দুঃখ কষ্ট ভুলতে থাকে। তখন তাদের কাছেও এই আশ্রম হয়ে ওঠে শ্রেষ্ঠ ঠিকানা।

নিয়মিত প্রানায়াম, যোগাসন, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, করতে করতে জীবন এক নতুন স্বাদ পেয়েছে। জীবন যেন সতেজ হয়ে উঠেছে।

৫।পরিবারের অশান্তি থেকে দূরে থাকা যায়

কিছু বৃদ্ধ বৃদ্ধারা প্রত্যহ কলধ্বনি শুনে থাকেন। তাদের নিজের তৈরি বাড়ীতে থাকা নিয়ে প্রশ্নের ঝড় ওঠে।

তাদের নিজেদেরই ওই বাড়ীতে নিজের ছেলে আর ছেলের বউ এর সঙ্গে একসাথে থাকাটা অসহনীয় হয়ে ওঠে।

বৃদ্ধাশ্রম তো এইসব অশান্তি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। প্রত্যহ মেডিটেশেন করার ফলে অতীতের সব অশান্তি জীবন থেকে বিদায় নেয়।

অশান্তি থেকে মুক্ত বৃদ্ধা
বৃদ্ধা

৬।মনের দুঃখ শেয়ার করা যায়

এখানে অন্য আরেক সত্য কাহিনী আপনাদের শোনাবো। সে আরেক বৃদ্ধা, বয়স ৫৬ মাত্র। সব কাজেই তিনি করতে পারেন।

সবে সবে উনি তার স্বামীকে হারিয়েছেন। যতদিন স্বামী বেঁচে ছিল, সব কিছু ঠিক ছিল। ছেলে আর ছেলের বউ এর দাপট ও সীমার মধ্যে ছিল।

স্বামী গত হওয়ার পরে সব কিছু বদলে গেল। দুই ছেলেই সংসার কে খুব ভালো করে গুছিয়ে নিয়েছিল তাদের বাবা বেঁচে থাকতে থাকতেই।

শুধু বাকি ছিল বৃদ্ধার নামে লিখা ভিটে বাড়ীটা।

একমাত্র সম্পত্তি সেই ভিটে বাড়ীটাও জোর করে বৃদ্ধাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে তার দুই ছেলে। আর তারপর থেকেই শুরু নির্যাতন।

নাতি-নাতনীরাও আর তাদের থাম্মার কাছে যায় না। থাম্মা নাকি বড্ড সেকেলে। থাম্মার রুমটা আজ স্টোর রুম হয়ে গিয়েছে।

যেসব জিনিষগুলো আর দরকারে আসে না যেমন পুরানো বই খাতা, পুরানো জামা কাপড় এই সব কিছু এখন ওই বৃদ্ধার রুমে।

কেউই তার রুমে আসে না, শুধু বর্জিত জিনিষগুলোই আসে। তার রুম সে নিজেই যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে।

কিন্তু তাতেও গঞ্জনা শুনতে হয় বউমাদের থেকে। বৃদ্ধা নাকি কিছুই কাজ করে না, নিজের রুমটা অবধি গুছিয়ে রাখতে পারে না।

এইরকম গঞ্জনা শুনতে শুনতে বৃদ্ধ হাঁপিয়ে উঠেছিলো। তাও সব কিছু সয়ে নিয়েছিল। কখনো কোন কিছু নিয়ে অভিযোগ জানায় নি।

তবুও দুই ছেলে একদিন সকাল সকাল ঝড় তুলেছিল। আজো ওই বৃদ্ধা সেইদিনের কথা ভাবে আর ভাবে সে এক দুঃস্বপ্ন দেখছে।

সেদিন সকালে খুব ভালো ব্রেকফাস্ট করিয়ে সেই বৃদ্ধাকে ভালো শাড়ি দিয়ে, তার ব্যাগ গুছিয়ে তাকে বসতে বলেছিল তাদের পরিবারের চার চাকার গাড়ীতে।

বৃদ্ধা জানতে চাওয়ায় দুই ছেলে বলেছিল তাকে ঘুরতে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরে গাড়ী দাঁড়ালো বৃদ্ধাশ্রমের কাছে।

তখনই সেই বৃদ্ধা সব কিছু বুঝে গিয়েছিল। আর শুধু চোখের জলে ভাসিয়েছিল সারাটা দিন।

ছেলেদেরকে বলেছিল যে – তারা একটা খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বলে হুক হুকিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন বৃদ্ধা।

ছেলেরা উত্তরে বলে নাকি মা এর কষ্ট তাদের সহ্য হচ্ছিল না। তাদের বউরা এতো খোঁটা দিত ,যে তারাও শান্তিতে কাজ করতে পারতো না।

বলেছিল যে চিন্তা না করতে, তারা দুই ছেলেই সপ্তাহে দুদিন আসবে।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার এই যে সেইদিনের পর থেকে আজ অবধি কেউই একদিনও আসে নি।

এই বৃদ্ধার মনের সব গ্লানি ঘুচে গেছে আরো অনেক বৃদ্ধাদের সাথে মনের কথা শেয়ার করে।

এই বৃদ্ধাও এখানে এসে এক নতুন জীবন পেয়েছে।

বৃদ্ধাশ্রম এর অপকারিতা

বৃদ্ধাশ্রমগুলো আছে বলেই তো কিছু অকৃতজ্ঞ লোক তার সুযোগ নেয়। ঘর বাড়ী থাকা সত্ত্বেও বৃদ্ধ বাবা মা কে ঠেলে দেয় ওই বৃদ্ধাশ্রমে। দেখে নেওয়া যাক বৃদ্ধাশ্রমের অপকারিতা গুলো –

১। নেই শান্তি বৃদ্ধাশ্রম এ

দায়িত্ব নেওয়ার জন্য থাকা সত্বেও বৃদ্ধ বাবা মা কে রেখে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে।

বয়স্ক মানুষ দুজন বাড়ী টা একটু একটু করে তৈরি করেছিল সারাটা জীবন ওখানে কাটাবে বলে। নিজের মনের মতো করে গুছিয়েছিল বাড়িটাকে। কতো স্বপ্নই না বুনেছিল।

জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটাও ওই বাড়ী থেকে নেওয়ার অনেক স্বাদ ছিল তাদের। আর এটাই তো স্বাভাবিক।

স্বপ্ন দেখাটা কি তাদের অপরাধ ছিল? নাকি বাড়িটা সুন্দরভাবে তৈরি করাটা ছিল অপরাধ?

বৃদ্ধাশ্রমে তো নিজের কিছু থাকবে না। সেই খোলা ছাদের এক কোনায় যে চন্দ্র মল্লিকা গাছ টা নিজের হাতে লাগিয়েছিল।

সেই গাছ টা তো বৃদ্ধাশ্রমে পাওয়া যাবে না।

বৃদ্ধাশ্রমে তো বাচ্চাদের সেই স্মৃতিগুলো থাকবে না।

বার্ধক্যে এসে তাদেরও তো ইচ্ছে করে ছেলের হাতে খাবার খেতে। ইচ্ছে করে সন্তানদের সাথে বেড়াতে যেতে।

বৃদ্ধাশ্রম মানেই তো বাড়তি সব ইচ্ছেগুলো যা সন্তানদের সাথে জড়িয়ে থাকে, তা বিসর্জন দেওয়া।

নেই শান্তি
শান্তি কি আছে বৃদ্ধাশ্রমে

২। পুরানো স্মৃতির সাথে বিচ্ছেদ

শিকড় উপড়ে গেলে বৃক্ষের মধ্যে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, সেই ক্ষত তৈরি হয় বৃদ্ধাশ্রম এ গেলে।

৩। মাথার ওপর ছাদ ভেঙ্গে যাওয়া

বার্ধক্যে সন্তানরাই মাথার ছাদ হয়ে ওঠে। সন্তানদের থেকে দূরে সরে যাওয়া মানেই তো মাথার ওপর ছাদ ভেঙ্গে যাওয়া।

৪। কেউ নেই

সন্তানরাই যখন দূরে সরিয়ে দেয়, মনে হয় যেন কেউ নেই।

৫। নতুন করে সব শুরু করা

বৃদ্ধাশ্রম এ গেলে নতুন করে সব শুরু করতে হয়। নতুন স্মৃতি তৈরি হয়। নতুন সাথী তৈরি হয়।

ওই বয়সে সব কিছু নতুন করে শুরু করা কষ্টকর হয়ে ওঠে।

৬। সন্তাদের সঙ্গ

যে সন্তানেরা তাদের বাবা মা কে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না, তারা তাদের বাবা মা কে দূরে সরিয়ে দিলেও, বাবা মা এর চিন্তা হতেই থাকে ।

বাবা মা রা সন্তান দের সঙ্গ না পাওয়ায় কষ্ট পেতে থাকেন।

৭। অতিরিক্ত ইচ্ছে, আবদার

বার্ধক্যে এসে তাদেরও তো ইচ্ছে করে সন্তানদের সাথে নদী বা সমুদ্রে বেড়াতে যেতে।

বৃদ্ধাশ্রম এ গেলে এইরকম ইচ্ছে আবদার সব কিছুর মৃত্যু ঘটে।

বৃদ্ধাশ্রম এর প্রয়োজনীয়তা

অনাথ আশ্রমের নাম নিশ্চয় শুনেছেন? অনাথ আশ্রমের কি উপকারিতা নেই? নিশ্চয় আছে, তা আপনারাও জানেন।

যে বাচ্চা টিকে দেখা শুনা করার কেউ নেই, তার পক্ষে ফুটপাথে থাকার চেয়ে অনাথ আশ্রমে থাকা অনেক শ্রেয়।

তাই বলে কি আপনি আপনার বাচ্চাদেরও কি ওই অনাথ আশ্রমে পাঠিয়ে দেবেন? আপনি এবং আপনার স্ত্রী দুজনেই তো অফিসে কাজ করেন। ফেরেন তো সেই রাত্রি ৯টা- ১০ টার সময়ে? কি করে দেখবেন বাচ্চাকে?

তাহলে কি বাচ্চাকেও আপনার বাবা মায়ের সাথে পাঠানোর কথা ভাবছেন? এই লাইনটা পড়ার সময়ে আপনার মনে একটা দারুন আঘাত লাগলো, তাই না? নিজের বাচ্চাকে অনাথ আশ্রমে? কখনোই না।

তাহলে নিজের বাবা মা কে কেন ওখানে পাঠানোর কথা ভাবছেন?

বৃদ্ধাশ্রম তো থাকতেই হবে। থাকতে হবে তাদের জন্য যাদের জীবনে যমরাজ এসে সব কিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

থাকতে হবে তাদের জন্য যাদের বংশে নিজের কেউ নেই, আর বার্ধক্য যাদের থেকে কেড়ে নিয়েছে কাজ করার ক্ষমতা।  

বৃদ্ধাশ্রম এর বিকল্প

যদি আপনার স্ত্রী আপনার বাবা মা এর উপস্থিতি সহ্য করতে পারছেন না, তাহলে এক কাজ করুন।

বৃদ্ধাশ্রমের পিছনে যে টাকাটা খরচ করেন সেই টাকা তে আপনার কাছাকাছি একটা দুই বেড রুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিন। কেনার ক্ষমতা থাকলে কিনেও নিতে পারেন।

পরে আপনার ই কাজে লাগবে।

সেই ফ্ল্যাটে আপনার স্ত্রীর বাবা মা কেও থাকার জায়গা করে দিন। আপনি তাদের ও যত্ন নিন।

আপনারা দুজনে মিলে এটাই ঠিক করুন যে আপনি আপনার স্ত্রীর বাবা মা এর খেয়াল রাখবেন যদি আপনার স্ত্রী আপনার বাবা মা এর খেয়াল রাখেন।

এতে পুরো পরিবার সুখে থাকবে। আপনাদের বাচ্চারাও বড় হয়ে আপনাদের বার্ধক্যের কষ্ট ঘোচাতে সম্ভব হবে। 

মানবতাবোধ

সন্তানেরা দূরে ঠেলে দেওয়ার পর ও যে জীবন এইভাবে সেজে উঠবে টা একমাত্র বৃদ্ধাশ্রম ই জানে। বৃদ্ধাশ্রম কতো অসহায় মানুষের ঠিকানা দিয়েছে।

বৃদ্ধাশ্রম এর পাশেই গড়ে উঠুক অনাথ আশ্রম গুলো।

যেসব শিশুরা তাদের বাবা মা এর মুখ দেখে নি, তারা দেখুক দাদীমা আর দাদুর মুখ, পরিচয় হোক দাদীমা আর দাদুর সাথে, পর হয়ে উঠুক আপন।

যে সব বৃদ্ধ বৃদ্ধারা নিজের বাড়ীতে নিজের সন্তানদের দ্বারাই পরিত্যক্ত, তারাও মুখ জীবন থেকে বিদায় নেওয়ার আগে পরিচয় করুক আগামী দিনের তরুন তরুণীদের সাথে।

এইভাবেই বাড়ুক তাদের বন্ধন।

বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে কিছু কথা বললেই বৃদ্ধ আর বৃদ্ধারা আঁতকে ওঠে। গাছ থেকে শিকড় কে আলাদা করে তাকে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করা কি যায়?

তবুও কিছু অকৃতজ্ঞ মানুষ এর জন্য তাদের যেতেই হয় বৃদ্ধাশ্রমে।

তাইতো কবি বলেছেন-

Youth is a blunder, Manhood a struggle, old age is regret.

Benjamin Disraeli.

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, সবাইকে ভালো রাখুন। চলুন, সবাই মিলে একসাথে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি। এই পৃথিবীর প্রতিটি কোনা ভরে উঠুক ঈশ্বরের আশীর্বাদে!  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক পোস্ট