পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক

এনভায়রনমেন্ট

পরিবেশের মধ্যেই তো গড়ে ওঠে জীবজন্তু। আর জীবের চারিদিক ঘিরে থাকে পরিবেশ। শুধুই কি পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বিদ্যমান? না, পরিবেশ ও জীবজন্তুর মধ্যে সম্পর্ক ও খুব গভীর।

তবে এখানে আমরা পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক নিয়েই আলোচোনা করবো।

পরিবেশ কি?

পরিবেশ হল সেইসব কিছু যা প্রাণীদের এবং উদ্ভিদদের জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করে। এই পরিবেশ প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম হতে পারে।

প্রাকৃতিক পরিবেশ

যেমন – সব মাটিতে সব গাছ জন্মায় না; কোন জায়গার জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে সেখানকার মানুষগুলো কেমন হবে, সেখানকার মাটিতে কি ধরনের গাছ হবে।

কৃত্রিম পরিবেশ

মানুষ যে পরিবেশ তৈরি করে তা কৃত্রিম পরিবেশ। যেমন- কারো বাড়ীতে সকাল সকাল সব বাচ্চাদের পড়তে দেখা যায়, মানে ওখানে পড়ার পরিবেশ আছে।

পরিবেশের উপাদান সমূহ

আমরা আমাদের চারিপাশে যা কিছু দেখি সেইসব কিছুই পরিবেশের সদস্য। যেমন ধরুন পুকুর, নদী, সমুদ্র, মাটি, গাছপালা, আকাশ-বাতাস, ঝড়-বৃষ্টি, ইত্যাদি।

তাহলে মানুষ কি পরিবেশের সদস্য নয়? মানুষও পরিবেশের সদস্য আবার মানুষ পরিবেশের ফসলও।

যখন একজন মানুষ তার ব্যবহার বা কথা বার্তা দিয়ে অন্য একজনকে প্রভাবিত করে তখন প্রথম মানুষটি পরিবেশের সদস্যের কাজ করে আর যে মানুষটি প্রভাবিত হয় সেই মানুষটি পরিবেশের ফসল হিসেবে কাজ করে।

পরিবেশের অদৃশ্য উপাদান

ভাইরাস, ব্যক্টিরিয়া, গ্রহ, নক্ষত্র, উপগ্রহ – এইসব কিছুই পরিবেশের অদৃশ্য সদস্য। এদের খালি চোখে যেমন দেখা যায় না ঠিক তেমনি এরা কিভাবে আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে তাও খালি চোখে দেখা যায় না।

পৃথিবীর চারিপাশের গ্রহগুলি পৃথিবীকে প্রভাবিত করে। পৃথিবীর আবর্তমান অবস্থা আমাদের ওপর প্রভাব ফেলে।

পরিবেশের ফসল

সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদ এই পরিবেশেরই ফসল। বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন ফসল হয় যেমন ধরুন – বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন গাছ জন্মায়।

কিছু কিছু গাছের বড় হয়ে ওঠার পেছনে মানুষের প্রয়োজন পড়ে না। আবার কিছু কিছু গাছ মানুষের যত্ন ছাড়া একদমই থাকতে পারে না।

মানুষ পরিবেশ

সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ। বুদ্ধি হল তার হাতিয়ার। আর পরিবেশ তো কন্ট্রোল করে সেই শ্রেষ্ঠ জীবকে।

এই শ্রেষ্ঠ জীব পরিবেশেরই ফসল। সঠিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ তো সঠিকই হবে। তাই মানুষ শ্রেষ্ঠ হওয়ার পেছনে পরিবেশের অবদান অনস্বীকার্য।

কোন মানুষের বুদ্ধি বেশী আবার কারো কম। এমন ভেদাভেদই বা কেন? এর জন্যও দায়ী পরিবেশ। শৈশববেলা থেকে আরম্ভ করে বার্ধক্য অবধি পুরো জীবনযাত্রায় পরিবেশ এর ভুমিকা অনস্বীকার্য।

প্রতিটি কর্মের জন্য বিভিন্ন বিভিন্ন পরিবেশ। যে লোকটা মেয়েমানুষের ওপর অত্যাচার করে তার জীবন খতিয়ে দেখলে দেখবেন যে তাদের পরিবারে মেয়েদের সম্মানহানি প্রায়ই হয়ে থাকে।

যে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে তাদের পরিবারে দিদি, বউদি, কাকিমাদের প্রায়ই অপমানে জর্জরিত করা হয়, বাড়ীর পুরুষেরা মদ্য পান করে রাত্রে ফিরে স্ত্রীর ওপর অকথ্য অত্যাচার করে থাকে, সে কি বড় হয়ে নারীদের মায়ের চোখে দেখবে?

এমন আশা করাটা বৃথা।

অন্যদিকে যে ছোটবেলা থেকে ঠিক তার উলটো পরিবেশে মানুষ হয়েছে, দেখেছে – তার বাবা তার মা কে বিশাল গুরুত্ব,সম্মান দিয়ে থাকে এবং তাদের দুজনের মধ্যেকার সম্পর্কও মধুর।

সেই লোকটা নারীদের অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। আর এটাই তো স্বাভাবিক।

আপনি বাড়ীতে বেলকনিতে একটা টব এর মধ্যে তুলসী গাছ লাগিয়েছেন, কিন্তু সেখানে শীতকালে সূর্যের আলো পৌছায় না, আবার গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদ্রে বেলকনি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।

আপনি প্রত্যহ জল দেওয়ার সময় পান না। কখনো কখনো জামা কাপড় মেলতে গিয়ে জামা কাপড়ের জলই টবের মধ্যে দিয়ে দেন।

অন্যদিকে, আপনার বাড়ীর বাহিরের দেওয়ালে যে এ সি মেশিনটির আউটডোর ইউনিটটি আছে তার নিচে প্রায়ই জল পড়তে থাকে।

সূর্যও তার তেজ সেখানে ছড়িয়ে দেয়, তবে সেই তেজ খুব কমও নয় আবার খুব বেশীও নয়।

মোটামুটি আলো, নিয়মিত জল, বাতাস পাওয়ার ফলে জায়গাটা ক্রমশই স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে, সেখানে খুব সুন্দর ভাবে তুলসী গাছটি তার শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছে।

আর যে তুলসী গাছটা আপনি আপনার বেলকনিতে টবের মধ্যে লাগিয়েছেন তা ক্রমশই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে।কি এর কারন? কারন- পরিবেশ।

আপনি তুলসী গাছের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিবেশ দরকার তা দিতে পারেন নি, কিন্তু প্রকৃতি বাহিরের তুলসী গাছটিকে তা দিতে পেরেছে।

ডিম্বানু আর শুক্রাণু এর মিলন মাতৃ জঠরে যে ভ্রূণের জন্ম হয় সেও তো পরিবেশের ওপরই নির্ভর করে।

যে পরিমানে যে যে হরমোন দরকার, সেই সেই হরমোন সেই সেই পরিমানে না থাকলেই তো বিপদে পড়তে হয় সেই ভ্রূণটিকে।

পরিবেশ দূষণ কাকে বলে

যে পরিবেশ আমাদের জন্ম দেয়,বুদ্ধি দেয়, বেড়ে ওঠার জন্য যা যা দরকার সেই সব কিছু দিয়ে থাকি, সেই পরিবেশ কে আমরা কি দিই দেখে নেওয়া যাক এক নজরে-

১। রেষারেষি

যে শিশু মাতৃগর্ভ এর মতো এক সুন্দর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এলো, তাকে আমরা কি শিক্ষা দিই? তাকে আমরা কিরকম পরিবেশ দিই?

শিশুটির সামনে চলতে থাকে এক বিশাল কম্পিটিসেন। কিসের এই দৌড়? তা আমরা কেউই জানি না। ৩ বছর বয়স থেকে তাকে শেখায় কিভাবে রেষারেষি করতে হয়।

৫ বছর বয়সেই তাকে কম্পিউটারের সামনে বসিয়ে বিদ্বান করার অদম্য প্রয়াস করে থাকি।

৮ বছর বয়সে শিশুটির চোখে বিশাল পাওয়ার এর চশমা দিয়েও আমরা থেমে থাকি না। তারপরেও আমরা তাকে প্রোগ্রামিং শেখাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ি।

স্কুলগুলো প্রতি সপ্তাহে টেস্ট নিয়ে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলে।

সকাল ৬ টায় তাদের ঘুম ভাঙিয়ে, কোনোরকমে মুখে জোর করে কিছু খাবার গুঁজে ৬.৩০ টার মধ্যে তৈরি করে স্কুল বাসে তুলে দিই।

ঘুমন্ত শিশুরা স্কুলের মধ্যেও সারাক্ষন দৌড়াতে থাকে। ক্লান্ত হয়ে বাড়ীতে ফিরেও তাদের শান্তি মিলে না। ধরিয়ে দেওয়া হয় প্রচুর এসাইন্মেন্ট, এক্টিভিটি, হোম ওয়ার্ক।

এই পরিবেশের ফসল কি হবে তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হবে মেশিনের যুগ। থাকবে না কোন দয়া- মায়া- মমতা। থাকবে না প্রকৃতির ছোঁয়া। আর এইভাবেই তো পরিবেশ কে দূষিত করে তুলছি আমরা।

আজ আমরা প্রকৃতি কে অবজ্ঞা করে যখন সঠিক পরিবেশ দিতে সক্ষম নয়, তখন প্রকৃতিই বা কি করবে?

২। কলহ এবং হিংসা

ছোট্ট শিশুরা তাদের নির্মল হৃদয় দিয়ে নিষ্পাপ মন দিয়ে সুন্দর চোখ দুটো দিয়ে দেখে যে তাদের সম্মুখে তাদের বাবা আর কাকুর তুমুল ঝগড়া একচুলো সম্পত্তি নিয়ে, তাদের মা আর ঠাকুমার মধ্যে ঝগড়া বাড়ীর টুকটাক জিনিশ নিয়ে।

এইসব শিশুরা বড় হয়ে কি রকম হবে তা নিশ্চয় খুবই পরিষ্কার। 

৩। দূষণ

প্রকৃতি তো সুন্দর পরিবেশই দিয়েছিল। তাই তো এতো মহান মহান ঋষি পুরুষেরা জন্ম নিয়েছিলেন এই পৃথিবীতে।

কিন্তু আজ কেন এই পৃথিবী ওই রকম ঋষি পুরুষের অভাব বোধ করে? ঋষি পুরুষদের জন্মাবার মতো পরিবেশ কি তাহলে নেই?

কেন এই পরিবর্তন? কে বা কারাই করলো এই পরিবর্তন? লোভ, হিংসা, রেষারেষি এইসবই তো মানুষের মনকে করে তুলেছে বিষাক্ত। পরিবারগুলোতে ইলেক্ট্রনিক্স গেজেট এর সংখ্যা বেড়েছে, মানুষের সংখ্যা কমেছে।

ইলেক্ট্রনিক্স গেজেট ভালো কিছুর সাথে খারাপ কিছুও দিয়ে থাকে। আর এরই ফলে দুষিত হয় পরিবেশ।

বেড়েছে গাড়ির সংখ্যা। মানুষ হয়েছে আয়াসি।  এরফলে বেড়েছে বাতাসে ধোঁয়ার পরিমান।

পরিবেশ ও মানুষের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল তৈরি করে মানুষ। আর তাই পরিবেশ দূষিত হয়।
পরিবেশ দূষণ

রাস্তাতে ভিড় বেড়েছে, মানুষের চেয়ে গাড়ির ভিড় বেশী। এর ফলে রাস্তাতে কে আগে পৌঁছাবে সেই নিয়ে শুরু হয়েছে রেষারেষি।

ফলে প্রতিটি গাড়ি হর্ন বাজাতে থাকে অনর্গল। এই কারনেই বেড়েছে শব্দ দূষণ।

জলের ব্যবহারে অবহেলা। রাস্তাতে টাইম কল দিয়ে জল পড়তেই থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে।

বালতি মগ এর ব্যবহার কমেছে। বেড়েছে ট্যাপ এর সংখ্যা।

ফলে আগে এক একজন চান করত এক বালতি জলে, আর এখন এক একজন চান করে তিন বালতি জলে যা তারা টেরও পায় না।

পুকুরের জলেই আগে রান্না করা হত। এখন পুকুরের জলে আবর্জনা ভাসানো হয়। ফলে পুকুরের জলও দুষিত হয়েছে।

পরিবেশ সচেতনতা কাকে বলে?

বন্ধু, ভাই- বোনেদের মধ্যে রেষারেষি,পরিবারের মধ্যে হিংসা, কলহ কমাতে পারলে আমরা আমাদের চারিপাশটাকেও হিংসা মুক্ত করে তুলতে পারবো।

নিজের বাড়ীকে আর তার চারপাশকে দূষণ মুক্ত করতে পারলে , আমরা পুরো দেশকে দূষণ মুক্ত করে তুলতে পারবো।

পরিবেশকে স্বচ্ছ রাখা, দূষণ মুক্ত রাখাই তো পরিবেশ সচেতনতা।

পরিবেশ নিয়েই তো প্রকৃতি। প্রকৃতি সৃষ্টির শুরুতে পরিবেশ সুন্দর রাখার দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিল বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষকে।

মানুষ সেই দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়েছে, তা বর্তমানের পরিবেশ দেখলেই পরিস্কার হয়ে যায়।

যেখানে সঠিক পরিবেশ থাকে না, সেখানে মুনি ঋষিরা জন্ম নেবেন কি করে?

যেমন এরোপ্লেন ল্যান্ড করার জন্য ভালো রান ওয়ে দরকার হয় ঠিক তেমনি, মুনি ঋষিদের জন্ম নেওয়ার জন্য চাই- স্বচ্ছ পরিবার, বীর নির্ভীক সৎ পিতা মাতা, সুন্দর স্কুল।

এই তিনটে জিনিষ ঠিক থাকলে, সেই মুনি ঋষিরাই ঠিক করে নেবেন বাকি পরিবেশগুলো।

চলুন আমরা সবাই নিজের পরিবারের আভ্যন্তরীণ পরিবেশ সঠিক করার দায়িত্ব নিই।

প্রতিটি পরিবারের পরিবেশ সঠিক হলে, প্রতিটি মানুষ পরিবেশ সম্পর্কেও সচেতন হবে। প্রতিটি মানুষ দায়িত্ববান হবে নিজের অঞ্চলের প্রতি।

প্রতিটি অঞ্চলে সঠিক পরিবেশ থাকলে, প্রতিটি রাজ্যেও সঠিক পরিবেশ গড়ে উঠবে।

প্রতিটি রাজ্যে সঠিক পরিবেশ থাকলে প্রতিটি দেশেও সঠিক পরিবেশ গড়ে উঠবে।

তাই চলুন দায়িত্ব নিয়ে আমাদের নিজ নিজ অঞ্চল্ কে দূষণ মুক্ত করার।

শপথ নিই পুকুরের জলকে কলুষিত না করার, শপথ নিই অযথা হর্ন না বাজাবার, পার্সোনাল গাড়িতে ট্র্যাভেল না করে পাবলিক গাড়িতে ট্র্যাভেল করার।

আমরা সকলে এইসব দায়িত্ব নিলে পৃথিবী হয়ে উঠবে সতেজ, পৃথিবী ভরে উঠবে বীর আর বীরাঙ্গনাতে। আর এইভাবেই তো পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠবে।

সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, সবাইকে ভালো রাখুন। চলুন, সবাই মিলে একসাথে এক সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলি। এই পৃথিবীর প্রতিটি কোনা ভরে উঠুক ঈশ্বরের আশীর্বাদে!  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সাম্প্রতিক পোস্ট